দাওয়াতি ক্ষেত্রে উগ্রতা ও কঠোরতা নয়; প্রয়োজন নরম ভাষা ও সুন্দর ব্যবহার

ভূমিকা:

যে আল্লাহর পথে আহ্বান করে তার চেয়ে উত্তম কথা আর কারও নেই।
আল্লাহ তাআলা বলেন,


وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِّمَّن دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ ‎

"তার কথা অপেক্ষা উত্তম কথা আর কার আছে যে, আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, সৎকর্ম করে এবং বলে, আমি একজন মুসলিম বা আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত?” [সূরা ফুসসিলাত/হা-মী-ম সাজদাহ: ৩৩]

আল্লাহর পথে আহ্বান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ নবী-রসুলদের কাজ। সুতরাং যারা এ পথে কাজ করবে তাদের কথা-বার্তা ও আচরণে নবী রসুলদের আদর্শ প্রতিবিম্ব হতে হবে। কারণ তাঁরাই দুনিয়ার মানুষের জন্য শ্রেষ্ঠ অনুকরণীয় আদর্শ। আর তাদের আদর্শ হল, নম্রতা পূর্ণ কথা ও সুন্দর আচরণ। দাওয়াতি ময়দানে রুক্ষ ও কর্কশ ভাষা এবং উগ্র আচরণ কখনও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
নিম্নে কুরআন-সুন্নাহ ও মনিষীদের উক্তির আলোকে বিষয়টি সংক্ষেপে আলোচনা করা হল:

১. আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দাওয়াতের পদ্ধতি শিক্ষা দিতে গিয়ে বলেন,


ادْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ ۖ وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ

“তোমার পালনকর্তার পথের প্রতি আহবান কর হিকমত (প্রজ্ঞা) ও উপদেশপূর্ণ কথার মাধ্যমে এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন সুন্দরতম পন্থায়।” [সূরা নহল: ১২৫]
ইমাম বাগাভি বলেন, কোন কোন মুফাসসির বলেছেন, ‘উপদেশপূর্ণ কথা’ হল,


هو القول اللين الرقيق من غير غلظة ولا تعنيف ا هـ
[تفسير البغوي : 5/52]

 

“নরম ও কোমল কথা-যাতে কঠোরতা ও উগ্রতা নেই।” [তাফসীরে বাগাবী ৫/৫২]

২. আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার সবচেয়ে ঔদ্ধত্য ও অহংকারী কাফের বাদশাহ ফেরাউনের নিকট মুসা ও হারুন আলাইহিমাস সালামকে দাওয়াত দেওয়ার পদ্ধতি শিক্ষা দিয়ে বলেন,


فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَّيِّنًا

“অতঃপর তোমরা তাকে নরম ভাষায় কথা বলো।” [সূরা ত্ব-হা: ৪৪]

৩. পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ ও শ্রেষ্ঠ মানুষ প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কথাবার্তা ও আচরণ কেমন ছিল আল্লাহ তাআলা তার বিবরণ দিচ্ছেন:

بِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللَّـهِ لِنتَ لَهُمْ ۖ وَلَوْ كُنتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ ۖ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ ۖ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّـهِ ۚ

“আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন পক্ষান্তরে আপনি যদি রুক্ষ ও কঠিন হৃদয়ের হতেন তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো। কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং কাজে কর্মে তাদের পরামর্শ করুন। অতঃপর যখন কোন কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন, তখন আল্লাহ তা’আলার উপর ভরসা করুন।” [সূরা আলে ইমরান: ১৫৯]

৪. প্রখ্যাত সাহাবী জারির বিন আব্দুল্লাহ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি:


من يحرم الرفق يحرم الخير كُله

“যে ব্যক্তি নম্র আচরণ হতে বঞ্চিত সে সকল প্রকার কল্যাণ হতে বঞ্চিত।” [সহীহ মুসলিম]

৫. রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,


" ِنَّ الرِّفْقَ لا يَكُونُ فِي شَيْءٍ إِلا زَانَهُ ، وَلا نُزِعَ مِنْ شَيْءٍ إِلا شَانَهُ

"নম্রতা ও কোমলতা যে জিনিসেই থাকবে তা সুন্দর ও সুষমা মণ্ডিত হবে আর কঠোরতা যে জিনিসে থাকবে তা কুৎসিত ও অকল্যাণকর হবে।" [সহীহ মুসলিম, আয়েশা রা. হতে বর্ণিত]

❍ একটি প্রসিদ্ধ আরবি প্রবাদ বাক্য হল:


من لانت كلمته وجبت محبته


“যার ভাষা নম্র হয় তার প্রতি অপরিহার্য ভাবে ভালবাসা সৃষ্টি হয়।”

❍ আল্লামা ইবনুল কাইয়েম রাহ. বলেন, মানুষের অন্তরে প্রভাব ফেলার জন্য সবচেয়ে উপকারী পদ্ধতি দুটি:

১) নম্র আচরণ
২) কল্যাণ কামনা
- এর মাধ্যমে অপরিচিত লোকের হৃদয় জয় করা যায়
- সাথী-বন্ধুদের সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় ও ভালবাসা স্থায়ী হয়।
- আর শত্রুর ক্রোধের আগুন নির্বাপিত হয় এবং তার ক্ষতি থেকে বাঁচা যায়।
[মাদারিজুস সালেকীন, ইমাম ইবনুল কাইয়েম, ২/৫৫১]


❍ আপনি দাওয়াতি কাজ করতে চান কিন্তু প্রতিপক্ষকে এমন ভাষায় কথা বলেন, যার কারণে সে ক্রোধান্বিত হয়ে উঠে সে আপনার কথা শুনবে না।

মা’মার বিন সোলাইমান বলেন, আমি আমার পিতা সোলাইমান [মৃত্যু: ১৪৩হি.] কে বলতে শুনেছি: “যদি তুমি কোন ব্যক্তিকে রাগিয়ে দাও সে কখনো তোমার কথা শুনবে না।” [আল আদাব আশ শারঈয়াহ, মাকদেসী ১/১৯৪]
বর্তমান শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম, রাহবার এবং একজন দরদি ও সফল দাঈ আল্লামা আব্দুল আজিজ বিন আব্দুল্লাহ বিন বায রাহ. বলেন,


" هذا العصر عصر الرفق والصبر والحكمة , وليس عصر الشدة . الناس أكثرهم في جهل , في غفلة إيثار للدنيا ,
فلا بد من الصبر , ولا بد من الرفق حتى تصل الدعوة , وحتى يبلغ الناس وحتى يعلموا . ونسأل الله للجميع الهداية
  "

“বর্তমান যুগ হল, নম্রতা, ধৈর্য এবং প্রজ্ঞার যুগ; কঠোরতার যুগ নয়। অধিকাংশ মানুষ অজ্ঞতা, অবহেলা ও পার্থিব স্বার্থপরতায় ডুবে রয়েছে।
অতএব অবশ্যই ধৈর্য ধারণ করতে হবে, অবশ্যই নম্র ব্যবহার করতে হবে যেন দাওয়াত পৌঁছে যায়..যেন মানুষের কাছে (আল্লাহর দীন) পৌঁছানো যায়..যেন মানুষ (সঠিক দীন) জানতে পারে।
আল্লাহর নিকট সকলের জন্য হেদায়েত প্রার্থনা করছি।” [মাজমু ফতোয়া/ফতোয়া সমগ্র, ৮/৩৭৬]


সুতরাং আসুন, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে আল্লাহর পথে দাওয়াতের স্বার্থে আমাদের ব্যক্তিগত সকল রাগ-অভিমান, আক্রোশ ইত্যাদিকে দমন করে আমাদের আচরণ-ব্যবহারকে আরও সুন্দর, আকর্ষণীয় আর ভাষাকে আরও কোমল ও নম্র করি। তাহলে আশা করা যায়, মহান আল্লাহ আমাদের দাওয়াতি কর্মে বরকত দান করবেন। ঘুণে ধরা সমাজকে আমরা পরিবর্তন করতে সক্ষম হব। সেই সাথে অর্জন করব, আখিরাতে দয়াময় আল্লাহর অবারিত পুরস্কার। নিশ্চয় আল্লাহ তাওফিক দানকারী।